বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন: বিশদ বিবরণ ও ব্যবহার

 বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন (Bearish Candlestick Pattern) হল একটি গুরুত্বপূর্ণ চার্টিং পদ্ধতি যা বাজারের নিম্নমুখী প্রবণতার সংকেত প্রদান করে। এই প্যাটার্নগুলো বাজারে বিক্রেতাদের আধিপত্য নির্দেশ করে এবং ভবিষ্যতে দামের পতনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। শেয়ারবাজার, ফরেক্স, ক্রিপ্টোকারেন্সি, এবং অন্যান্য আর্থিক বাজারে ট্রেডারদের জন্য বেয়ারিশ প্যাটার্ন বোঝা এবং সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন কী?

বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন এমন একটি চার্ট প্যাটার্ন যা নির্দেশ করে যে বাজারের নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হতে চলেছে। এই প্যাটার্নগুলি সাধারণত উচ্চ প্রাইস থেকে নিম্ন প্রাইসের দিকে দামের পরিবর্তন বোঝায়।

বৈশিষ্ট্য:

  1. ক্লোজিং প্রাইস ওপেনিং প্রাইসের চেয়ে কম হয়।
  2. বড় বডি এবং ছোট উইক/শ্যাডো থাকতে পারে।
  3. লাল বা কালো রঙের ক্যান্ডেল, যা দামের নিম্নগতি নির্দেশ করে।

বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্নের প্রকারভেদ

বিভিন্ন ধরণের বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন রয়েছে, যা বাজারের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।

১. শুটিং স্টার (Shooting Star)

শুটিং স্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং সম্ভাব্য নিম্নমুখী রিভার্সালের সংকেত প্রদান করে। এটি একটি ছোট বডি এবং একটি লম্বা উপরের শ্যাডো নিয়ে গঠিত, যেখানে উপরের শ্যাডো বডির কমপক্ষে দ্বিগুণ। নিচের শ্যাডো সাধারণত খুব ছোট বা একেবারেই থাকে না। শুটিং স্টার প্যাটার্নটি দেখায় যে সেশনের সময় ক্রেতারা দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলেও, বিক্রেতারা বাজারে আধিপত্য করে দামকে নিচে নামিয়েছে এবং ক্লোজিং প্রাইস ওপেনিং প্রাইসের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এটি প্রায়শই রেসিস্ট্যান্স লেভেলে দেখা যায় এবং ট্রেডারদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হিসেবে কাজ করে, যা শর্ট পজিশন নেওয়ার বা মুনাফা তুলে নেওয়ার সময় নির্দেশ করতে পারে।

  • চেহারা: ছোট বডি এবং লম্বা উপরের উইক।
  • অর্থ: এটি ঊর্ধ্বমুখী ট্রেন্ডের শেষে গঠিত হয় এবং নির্দেশ করে যে দাম কমতে পারে।
  • ব্যবহার: এটি বিক্রির সংকেত প্রদান করে।

২. হ্যাঙ্গিং ম্যান (Hanging Man)

হ্যাঙ্গিং ম্যান একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং সম্ভাব্য নিম্নমুখী রিভার্সালের সংকেত প্রদান করে। এটি একটি ছোট বডি এবং একটি লম্বা নিম্ন শ্যাডো নিয়ে গঠিত, যেখানে নিম্ন শ্যাডো বডির কমপক্ষে দ্বিগুণ। উপরের শ্যাডো খুব ছোট বা একেবারেই থাকে না। হ্যাঙ্গিং ম্যান প্যাটার্নটি দেখায় যে সেশনের সময় বিক্রেতারা দাম কমিয়ে দিয়েছিল, তবে ক্রেতারা কিছুটা দাম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এটি এককভাবে বুলিশ দেখাতে পারে, ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে এটি বিক্রেতাদের সক্রিয়তার সূচক এবং বাজারে দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। রেসিস্ট্যান্স লেভেলে এই প্যাটার্নটি ট্রেডারদের জন্য সতর্ক সংকেত হয়ে ওঠে, যা বাজার থেকে বের হওয়ার বা শর্ট পজিশন নেওয়ার সময় নির্দেশ করে।
  • চেহারা: ছোট বডি এবং লম্বা নিচের উইক।
  • অর্থ: এটি ঊর্ধ্বমুখী ট্রেন্ডের শেষে গঠিত হয় এবং বাজারের নিম্নমুখী ঘোরার ইঙ্গিত দেয়।
  • ব্যবহার: এটি একটি বেয়ারিশ রিভার্সাল সংকেত।

৩. বেয়ারিশ এনগালফিং (Bearish Engulfing) 

বিয়ারিশ এঙ্গালফিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং সম্ভাব্য নিম্নমুখী রিভার্সালের ইঙ্গিত দেয়। এটি দুটি ক্যান্ডেলের সমন্বয়ে গঠিত: প্রথমটি একটি ছোট সবুজ (বুলিশ) ক্যান্ডেল, যা ক্রেতাদের শক্তি নির্দেশ করে, এবং দ্বিতীয়টি একটি বড় লাল (বিয়ারিশ) ক্যান্ডেল, যা প্রথম ক্যান্ডেলের সম্পূর্ণ বডিকে ঢেকে ফেলে। এই প্যাটার্নটি দেখায় যে ক্রেতারা সেশনের শুরুতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও, বিক্রেতারা শক্তিশালী হয়ে বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। বিয়ারিশ এঙ্গালফিং প্যাটার্ন সাধারণত রেসিস্ট্যান্স লেভেলে তৈরি হয় এবং ট্রেডারদের জন্য শর্ট পজিশন নেওয়া বা মুনাফা তুলে নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হিসেবে কাজ করে। তবে এই প্যাটার্ন বিশ্লেষণের জন্য অন্যান্য প্রযুক্তিগত সূচকের সঙ্গে মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

  • চেহারা: দুটি ক্যান্ডেল নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় ক্যান্ডেল প্রথম ক্যান্ডেলের তুলনায় বড় এবং সম্পূর্ণরূপে এটিকে ঢেকে ফেলে।
  • অর্থ: এটি বিক্রেতাদের শক্তি বৃদ্ধি এবং বাজারের নিম্নগতি নির্দেশ করে।
  • ব্যবহার: এটি বিক্রির জন্য একটি শক্তিশালী সংকেত প্রদান করে।

৪. ডার্ক ক্লাউড কভার (Dark Cloud Cover)

ডার্ক ক্লাউড কভার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং সম্ভাব্য নিম্নমুখী রিভার্সালের ইঙ্গিত দেয়। এটি দুটি ক্যান্ডেলের সমন্বয়ে গঠিত: প্রথমটি একটি বড় সবুজ (বুলিশ) ক্যান্ডেল, যা ক্রেতাদের শক্তি নির্দেশ করে, এবং দ্বিতীয়টি একটি বড় লাল (বিয়ারিশ) ক্যান্ডেল, যা প্রথম ক্যান্ডেলের বডির অর্ধেক বা তার বেশি ঢেকে ফেলে। এই প্যাটার্নটি দেখায় যে সেশনের শুরুতে দাম বেড়েছিল, কিন্তু বিক্রেতারা শক্তিশালী হয়ে দামকে নিচে নামিয়েছে এবং বাজারের প্রবণতায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। ডার্ক ক্লাউড কভার সাধারণত রেসিস্ট্যান্স লেভেলে তৈরি হয় এবং এটি ট্রেডারদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হিসেবে কাজ করে, যা শর্ট পজিশন নেওয়া বা বাজার থেকে বের হওয়ার সময় নির্দেশ করতে পারে।

  • চেহারা: দুটি ক্যান্ডেল নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় ক্যান্ডেল প্রথমটির ওপরে শুরু হয় এবং তার বডির অর্ধেকের বেশি ঢুকে পড়ে।
  • অর্থ: এটি নির্দেশ করে যে ক্রেতারা বাজারের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে এবং বিক্রেতারা আধিপত্য বিস্তার করছে।
  • ব্যবহার: এটি বাজারে একটি রিভার্সাল সংকেত প্রদান করে।

৫. থ্রি ব্ল্যাক ক্রোস (Three Black Crows) : থ্রি ব্ল্যাক ক্রো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে বা একটি কনসোলিডেশন পিরিয়ডের পর দেখা যায় এবং নিম্নমুখী ধারাবাহিকতার ইঙ্গিত দেয়। এই প্যাটার্নটি তিনটি ধারাবাহিক বড় লাল (বা কালো) ক্যান্ডেল নিয়ে গঠিত, যেখানে প্রতিটি ক্যান্ডেলের ওপেনিং প্রাইস আগের ক্যান্ডেলের বডির মধ্যে থাকে এবং ক্লোজিং প্রাইস আগের ক্লোজিং প্রাইসের নিচে থাকে। এটি বিক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং বাজারে বিয়ারিশ মোমেন্টামের সূচক। থ্রি ব্ল্যাক ক্রো সাধারণত রেসিস্ট্যান্স লেভেলের কাছাকাছি দেখা যায় এবং ট্রেডারদের জন্য এটি বাজার থেকে বের হওয়ার বা শর্ট পজিশন নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত প্রদান করে। তবে অতিরিক্ত বিক্রয়ের সম্ভাবনা বোঝার জন্য ভলিউম এবং অন্যান্য সূচকের সঙ্গে এই প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করা জরুরি।

  • চেহারা: তিনটি পরপর দীর্ঘ বেয়ারিশ ক্যান্ডেল নিয়ে গঠিত।
  • অর্থ: এটি একটি শক্তিশালী বেয়ারিশ সিগনাল এবং নিম্নমুখী বাজারের ইঙ্গিত।
  • ব্যবহার: এটি নিশ্চিত করে যে বিক্রেতারা সম্পূর্ণভাবে বাজারে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।


বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্নের ব্যবহার

১. রিভার্সাল শনাক্ত করতে:

বেয়ারিশ প্যাটার্ন ঊর্ধ্বমুখী ট্রেন্ডের শেষে গঠিত হয়ে বাজারের নিম্নগতি নির্দেশ করে।

২. বিক্রির সময় নির্ধারণে:

এই প্যাটার্নগুলো বাজারে বিক্রির জন্য সঠিক সময় নির্দেশ করে।

৩. স্টপ লস সেট করতে:

ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে বেয়ারিশ প্যাটার্ন ব্যবহার করে স্টপ লস নির্ধারণ করা যায়।

৪. বর্তমান বাজারের শক্তি বিশ্লেষণে:

বাজারে বিক্রেতারা কতটা শক্তিশালী তা বোঝার জন্য এই প্যাটার্ন কার্যকর।


বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন বিশ্লেষণের টিপস

  1. ভলিউম দেখুন: ভলিউম বেশি হলে প্যাটার্ন বেশি নির্ভরযোগ্য।
  2. সমর্থন ও প্রতিরোধ স্তর ব্যবহার করুন: বেয়ারিশ প্যাটার্ন প্রতিরোধ স্তরের কাছাকাছি হলে তা কার্যকর।
  3. অন্যান্য ইন্ডিকেটর ব্যবহার করুন: MACD, RSI, বা মুভিং অ্যাভারেজের সাথে মিলিয়ে এই প্যাটার্নের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করুন।
  4. ফেক আউট থেকে সতর্ক থাকুন: শুধুমাত্র প্যাটার্ন দেখে সিদ্ধান্ত না নিয়ে সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতি যাচাই করুন।

উদাহরণ: বেয়ারিশ প্যাটার্নের বাস্তব ব্যবহার

ধরা যাক, একটি শেয়ারের দাম ক্রমশ বাড়ছিল এবং একটি শুটিং স্টার প্যাটার্ন গঠিত হয়েছে। এটি নির্দেশ করে যে ক্রেতারা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং বিক্রেতারা শক্তিশালী হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, একজন ট্রেডার স্টপ লস সেট করে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।


উপসংহার

বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন বাজারের নিম্নমুখী গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারলে একজন ট্রেডার ঝুঁকি কমিয়ে লাভজনক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে, এটি কখনোই একা ব্যবহার করা উচিত নয়। অন্যান্য প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করলে এর কার্যকারিতা বাড়ে।

নিয়মিত চর্চা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্নের কার্যকর ব্যবহার শেখা সম্ভব।

Video material: 


এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

স্ট্র্যাডল এবং স্ট্র্যাংল: কী এবং কীভাবে করতে হয়?

SIP করার সময় ঝুঁকি এড়ানোর উপায়