১৯৯০ সালের পর থেকে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (RBI) মুদ্রানীতি প্রয়োগের বিবরণ

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (RBI) ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা। মুদ্রানীতি হলো অর্থনীতিতে টাকার সরবরাহ, সুদের হার, এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ১৯৯০ সালের পর থেকে, RBI মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।

১৯৯০-এর দশকের মুদ্রানীতির যুগান্তকারী পরিবর্তন

১. উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়ন (LPG) নীতি:

১৯৯১ সালে ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি চালু হলে RBI মুদ্রানীতি প্রণয়নে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।

  • মূল লক্ষ্য:
    • মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
    • বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো।
    • আর্থিক বাজারের উদারীকরণ।
  • উপায়:
    • মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে উচ্চ সুদের হার।
    • বেসরকারি ব্যাঙ্কের প্রবেশের অনুমতি।
    • রেপো এবং রিভার্স রেপো রেট চালু।

২. চাহিদা ও সরবরাহ ভিত্তিক মুদ্রানীতি:

RBI সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ পরিচালনা করতে শুরু করে।

  • নগদ সংরক্ষণ অনুপাত (CRR) এবং স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও (SLR) প্রয়োজন অনুযায়ী সামঞ্জস্য করা হয়।

২০০০-এর দশক: আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতি মনোযোগ

১. মুদ্রাস্ফীতির উপর নিয়ন্ত্রণ:

২০০০-এর দশকে মুদ্রাস্ফীতির উপর বেশি নজর দেওয়া হয়। RBI মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

  • মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে:
    • রেপো রেট বাড়ানো।
    • SLR হ্রাস করে ব্যাঙ্কগুলোর কাছে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি।

২. উদ্ভাবনী পদক্ষেপ:

  • রেট কাটা ও বাড়ানো: আর্থিক চক্রের চাহিদা অনুযায়ী রেট পরিবর্তন।
  • মুদ্রানীতি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: জনগণ ও বাজারে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য।

৩. ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময়:

  • অর্থনীতিকে মন্দার হাত থেকে বাঁচাতে RBI সুদের হার কমায় এবং ব্যাঙ্কগুলোর জন্য নগদ প্রবাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
  • লিকুইডিটি বাড়ানোর জন্য CRR কমানো হয়।

২০১০-এর দশক: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি

১. মুদ্রানীতির কাঠামো সংস্কার:

২০১৬ সালে মুদ্রানীতি কমিটি (Monetary Policy Committee - MPC) গঠন করা হয়। এটি RBI-এর মুদ্রানীতির প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক করে তোলে।

  • মূল লক্ষ্য:
    • মুদ্রাস্ফীতি ৪%-এর মধ্যে রাখা (±২% সহনশীলতা)।
    • মূল্য স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

২. সুদের হারের নিয়ন্ত্রণ:

RBI-এর প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে রেপো রেট এবং রিভার্স রেপো রেট।

  • রেপো রেটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কাছে অর্থ ধার দেওয়া হয়।
  • রিভার্স রেপো রেটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো RBI-তে তাদের উদ্বৃত্ত টাকা জমা করে।

৩. নোট বাতিলের সময় ভূমিকা (২০১৬):

  • অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং কালো টাকা কমাতে RBI সক্রিয়ভাবে কাজ করে।
  • নগদের সংকট মোকাবিলায় তাত্ক্ষণিক মুদ্রাস্বল্পতা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়।

২০২০-এর দশক: কোভিড-১৯ মহামারী এবং পরবর্তী সময়ে মুদ্রানীতি

১. কোভিড-১৯ এর সময় RBI-এর পদক্ষেপ:

  • মহামারীর সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে RBI রেপো রেট ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনে।
  • ব্যাংকগুলোর জন্য লিকুইডিটি বাড়ানো এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসার জন্য সহজ ঋণের ব্যবস্থা করে।
  • Targeted Long Term Repo Operations (TLTRO): এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বন্ড বাজারে লিকুইডিটি বাড়ানো হয়।

২. মুদ্রাস্ফীতি এবং বৃদ্ধি মধ্যে ভারসাম্য:

  • মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রেপো রেট বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করা হয়।
  • খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানির দামের ওঠানামা থেকে প্রাপ্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে কার্যকর পদক্ষেপ।

RBI-এর মুদ্রানীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলো

১. রেপো রেট এবং রিভার্স রেপো রেট:
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্য বজায় রাখতে।

২. CRR এবং SLR:
ব্যাংকগুলোর জন্য রিজার্ভের পরিমাণ ঠিক করার মাধ্যমে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ।

৩. মুদ্রার সরবরাহ:
অর্থনীতিতে টাকার যোগান বাড়ানো বা কমানোর জন্য নীতি গ্রহণ।

৪. মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্য স্থিরকরণ:
MPC-এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট মুদ্রাস্ফীতির হার বজায় রাখা।

৫. উন্নয়নমূলক নীতি:
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং ছোট ব্যবসার সহায়তার জন্য বিশেষ উদ্যোগ।

১৯৯০ সালের পর থেকে RBI ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রানীতির কাঠামো উন্নত করেছে। উদারীকরণ থেকে শুরু করে মহামারীর সময় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা পর্যন্ত, RBI এর পদক্ষেপগুলো ভারতের অর্থনীতিকে শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে।

বর্তমান সময়ে, RBI-এর প্রধান লক্ষ্য হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতেও এই নীতিগুলো ভারতের আর্থিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

স্ট্র্যাডল এবং স্ট্র্যাংল: কী এবং কীভাবে করতে হয়?

SIP করার সময় ঝুঁকি এড়ানোর উপায়

বেয়ারিশ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন: বিশদ বিবরণ ও ব্যবহার