ক্যান্ডেলস্টিক: বিশদে এর ব্যবহার এবং প্রাসঙ্গিকতা
ক্যান্ডেলস্টিক (Candlestick) চার্টিং একটি প্রাচীন এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি যা বিনিয়োগকারীদের এবং ব্যবসায়ীদের শেয়ারবাজার, মুদ্রা বাজার এবং অন্যান্য আর্থিক বাজার বিশ্লেষণে সহায়তা করে। এটি প্রথম জাপানে উদ্ভাবিত হয় এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ক্যান্ডেলস্টিকের মাধ্যমে বাজারের গতি, ট্রেন্ড, এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মনোভাব বিশ্লেষণ করা যায়।
ক্যান্ডেলস্টিকসের ইতিহাস
ক্যান্ডেলস্টিক চার্টের ধারণাটি প্রথম বিকাশ করেছিলেন জাপানি চাল ব্যবসায়ী হোমা মুন্হিসা ১৭ শতকে। হোমা লক্ষ্য করেছিলেন যে মানুষের আবেগ চালের দামকে প্রভাবিত করে। তিনি তার পর্যবেক্ষণগুলি একটি ভিজ্যুয়াল পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করেন, যা পরবর্তীতে ক্যান্ডেলস্টিক চার্টিং পদ্ধতিতে রূপ নেয়।
১৯৯০-এর দশকে এই পদ্ধতি পশ্চিমা বিশ্বের প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। স্টিভ নিসন (Steve Nison) তার বই "Japanese Candlestick Charting Techniques"-এর মাধ্যমে এটি আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতি লাভ করান।
একটি ক্যান্ডেলস্টিক হলো একটি চার্টিং পদ্ধতি যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনও আর্থিক উপকরণের ওপেন (Open), ক্লোজ (Close), হাই (High), এবং লো (Low) মূল্য চিত্রিত করে। প্রতিটি ক্যান্ডেলস্টিক চারটি মূল অংশ নিয়ে গঠিত:
- বডি (Body): ওপেন এবং ক্লোজ দামের মধ্যবর্তী অংশ।
- উইক বা শ্যাডো (Wick/Shadow): সর্বোচ্চ (High) এবং সর্বনিম্ন (Low) দামের প্রতিফলন।
- রঙ: বডির রঙ সাধারণত বাজারের গতিবিধি নির্দেশ করে – সবুজ বা সাদা রঙ (দাম বেড়েছে) এবং লাল বা কালো রঙ (দাম কমেছে)।
ক্যান্ডেলস্টিকের উপাদানসমূহ
বুলিশ ক্যান্ডেল (Bullish Candle):
যখন ক্লোজিং দাম ওপেনিং দামের চেয়ে বেশি হয়। এটি বাজারের ক্রেতাদের আধিপত্য নির্দেশ করে।বেয়ারিশ ক্যান্ডেল (Bearish Candle):
যখন ক্লোজিং দাম ওপেনিং দামের চেয়ে কম হয়। এটি বাজারের বিক্রেতাদের আধিপত্য নির্দেশ করে।ডোজি (Doji):
ওপেন এবং ক্লোজ দাম প্রায় সমান থাকে, যা বাজারের অনিশ্চয়তা বা সমান ক্রয়-বিক্রয় চাপের ইঙ্গিত দেয়।
ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন এবং তার ব্যবহার
বাজারের ভবিষ্যৎ গতিবিধি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় প্যাটার্ন:
১. সিঙ্গেল ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন
হ্যামার (Hammer): নিম্নগামী বাজারের শেষে গঠিত হয়। এটি বাজারের উল্টো ঘোরার ইঙ্গিত দেয়।হ্যামার ক্যান্ডেল একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের নিম্নমুখী প্রবণতার শেষে তৈরি হয় এবং একটি সম্ভাব্য ঊর্ধ্বমুখী রিভার্সালের সংকেত দেয়। এই ক্যান্ডেলের মূল বৈশিষ্ট্য হলো একটি ছোট বডি (যা ওপেনিং এবং ক্লোজিং প্রাইসের মধ্যে থাকে) এবং একটি লম্বা নিম্ন শ্যাডো, যা বডির কমপক্ষে দ্বিগুণ। এটি দেখায় যে সেশনের সময় দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল, তবে ক্রেতারা বাজারে প্রবেশ করে দামকে ওপরে তুলেছে এবং ক্লোজিং প্রাইস ওপেনিং প্রাইসের কাছাকাছি এনেছে। একটি হ্যামার ক্যান্ডেল সাধারণত সবুজ বা লাল হতে পারে, তবে সবুজ রঙের হ্যামার শক্তিশালী বুলিশ সংকেত প্রদান করে। এটি সাপোর্ট লেভেলে দেখা গেলে ট্রেডারদের জন্য এটি বাজারে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ নির্দেশ করতে
শুটিং স্টার (Shooting Star):
ঊর্ধ্বগামী বাজারের শেষে গঠিত হয়। এটি দাম কমার পূর্বাভাস দেয়।শুটিং স্টার ক্যান্ডেল একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং সম্ভাব্য নিম্নমুখী রিভার্সালের সংকেত দেয়। এই ক্যান্ডেলের বৈশিষ্ট্য হলো একটি ছোট বডি (যা ওপেনিং এবং ক্লোজিং প্রাইসের মধ্যে থাকে) এবং একটি লম্বা উপরের শ্যাডো, যা বডির কমপক্ষে দ্বিগুণ। এটি দেখায় যে সেশনের সময় দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল, তবে বিক্রেতারা বাজারে প্রবেশ করে দামকে নিচে নামিয়ে এনেছে, ফলে ক্লোজিং প্রাইস ওপেনিং প্রাইসের কাছাকাছি চলে আসে। শুটিং স্টার সাধারণত লাল বা সবুজ হতে পারে, তবে লাল শুটিং স্টার একটি শক্তিশালী বিয়ারিশ সংকেত প্রদান করে। এটি রেসিস্ট্যান্স লেভেলে দেখা গেলে ট্রেডারদের জন্য এটি বাজার থেকে বের হওয়ার বা শর্ট পজিশন নেওয়ার একটি সতর্কতা নির্দেশ করে।
২. ডাবল ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন
বুলিশ এনগালফিং (Bullish Engulfing):
দুই ক্যান্ডেল নিয়ে গঠিত, যেখানে দ্বিতীয়টি প্রথম ক্যান্ডেলের চেয়ে বড় এবং এটি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়।বুলিশ এঙ্গালফিং একটি শক্তিশালী ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের নিম্নমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং ভবিষ্যতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার সম্ভাবনা নির্দেশ করে। এটি দুটি ক্যান্ডেলের সমন্বয়ে গঠিত: প্রথমটি একটি ছোট লাল (বিয়ারিশ) ক্যান্ডেল, যা বিক্রেতাদের শক্তি দেখায়, এবং দ্বিতীয়টি একটি বড় সবুজ (বুলিশ) ক্যান্ডেল, যা আগের ক্যান্ডেলের সম্পূর্ণ বডিকে ঢেকে ফেলে। এই প্যাটার্ন ক্রেতাদের শক্তিশালী উপস্থিতি নির্দেশ করে এবং ট্রেডারদের জন্য একটি বুলিশ (ঊর্ধ্বমুখী) সংকেত হিসেবে কাজ করে। বুলিশ এঙ্গালফিং প্যাটার্ন সাধারণত সাপোর্ট লেভেলে তৈরি হয় এবং বাজারে প্রবেশের একটি ভালো সুযোগ নির্দেশ করতে পারে।বেয়ারিশ এনগালফিং (Bearish Engulfing):
দ্বিতীয় ক্যান্ডেল প্রথমটির চেয়ে বড় এবং এটি নিম্নমুখী প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়।বিয়ারিশ এঙ্গালফিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং ভবিষ্যতে নিম্নমুখী প্রবণতার সম্ভাবনা নির্দেশ করে। এটি দুটি ক্যান্ডেলের সমন্বয়ে গঠিত: প্রথমটি একটি ছোট সবুজ (বুলিশ) ক্যান্ডেল, যা ক্রেতাদের শক্তি দেখায়, এবং দ্বিতীয়টি একটি বড় লাল (বিয়ারিশ) ক্যান্ডেল, যা আগের ক্যান্ডেলের সম্পূর্ণ বডিকে ঢেকে ফেলে। এই প্যাটার্ন বিক্রেতাদের শক্তিশালী উপস্থিতি এবং ক্রেতাদের দুর্বলতার প্রতিফলন ঘটায়। বিয়ারিশ এঙ্গালফিং প্যাটার্ন সাধারণত একটি রেসিস্ট্যান্স লেভেলে দেখা যায় এবং ট্রেডারদের জন্য শর্ট পজিশন নেওয়া বা বাজার থেকে বের হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হিসেবে কাজ করে।
৩. ট্রিপল ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন
মর্নিং স্টার (Morning Star):
নিম্নমুখী বাজারের শেষে গঠিত একটি বুলিশ প্যাটার্ন।মর্নিং স্টার ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন একটি বুলিশ রিভার্সালের প্রতীক, যা সাধারণত বাজারের নিম্নমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায়। এটি তিনটি ক্যান্ডেলের সমন্বয়ে গঠিত: প্রথমটি একটি বড় লাল (বিয়ারিশ) ক্যান্ডেল, যা নিম্নমুখী প্রবণতার ধারাবাহিকতা নির্দেশ করে। দ্বিতীয়টি একটি ছোট বডির ক্যান্ডেল (ডোজি বা স্পিনিং টপ), যা বাজারে দ্বিধা বা স্থিতাবস্থার ইঙ্গিত দেয়। তৃতীয়টি একটি বড় সবুজ (বুলিশ) ক্যান্ডেল, যা প্রায় প্রথম ক্যান্ডেলের মধ্যবিন্দুর ওপরে ক্লোজ হয় এবং বাজারের ঊর্ধ্বমুখী রিভার্সাল নিশ্চিত করে। মর্নিং স্টার প্যাটার্ন সাধারণত সাপোর্ট লেভেলে দেখা যায় এবং ক্রেতাদের শক্তিশালী উপস্থিতি নির্দেশ করে, যা বাজারে প্রবেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত প্রদান করে।ইভনিং স্টার (Evening Star):
ঊর্ধ্বমুখী বাজারের শেষে গঠিত একটি বেয়ারিশ প্যাটার্ন।ইভনিং স্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন, যা সাধারণত বাজারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার শেষে দেখা যায় এবং ভবিষ্যতে নিম্নমুখী রিভার্সালের সংকেত প্রদান করে। এটি তিনটি ক্যান্ডেলের সমন্বয়ে গঠিত: প্রথমটি একটি বড় সবুজ (বুলিশ) ক্যান্ডেল, যা ক্রেতাদের শক্তি নির্দেশ করে; দ্বিতীয়টি একটি ছোট বডির ক্যান্ডেল (ডোজি বা স্পিনিং টপ), যা বাজারের দ্বিধা বা স্থিতাবস্থার প্রতিফলন ঘটায়; এবং তৃতীয়টি একটি বড় লাল (বিয়ারিশ) ক্যান্ডেল, যা বিক্রেতাদের আধিপত্য এবং দাম কমার সম্ভাবনা নিশ্চিত করে। ইভনিং স্টার প্যাটার্ন সাধারণত একটি রেসিস্ট্যান্স লেভেলে দেখা যায় এবং ট্রেডারদের জন্য বাজার থেকে বের হওয়া বা শর্ট পজিশন নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হিসেবে কাজ করে।
ক্যান্ডেলস্টিকের ব্যবহার
১. বাজারের ট্রেন্ড নির্ধারণে:
ক্যান্ডেলস্টিকের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে বাজারের বর্তমান ট্রেন্ড এবং ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
২. সমর্থন এবং প্রতিরোধ (Support and Resistance):
নির্দিষ্ট স্তরে ক্যান্ডেলস্টিক গঠনের মাধ্যমে বাজারের সমর্থন বা প্রতিরোধ অঞ্চল নির্ধারণ করা যায়।সাপোর্ট এবং রেসিস্ট্যান্স হলো টেকনিক্যাল বিশ্লেষণের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর, যা বাজারের দাম কোথায় থামতে বা বিপরীত হতে পারে তা নির্ধারণ করে। ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন এই স্তরগুলো বোঝাতে সাহায্য করে, কারণ এগুলো প্রাইস অ্যাকশনের ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা প্রদান করে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের শক্তির পরিবর্তন নির্দেশ করে।
সাপোর্ট স্তরে ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন:
যখন বাজারের দাম সাপোর্ট স্তরে পৌঁছায়, তখন হ্যামার, বুলিশ এঙ্গালফিং, বা মর্নিং স্টারের মতো প্যাটার্ন প্রায়ই তৈরি হয়। এগুলো দেখায় যে ক্রেতারা সক্রিয় হয়েছে এবং দাম বাড়তে পারে।রেসিস্ট্যান্স স্তরে ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন:
রেসিস্ট্যান্স স্তরে শুটিং স্টার, বিয়ারিশ এঙ্গালফিং, বা ইভনিং স্টারের মতো প্যাটার্ন দেখা যায়। এগুলো ইঙ্গিত দেয় যে বিক্রেতারা বাজারে আধিপত্য করছে এবং দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।প্রাইস ব্রেকআউট বা রিভার্সাল:
ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন সাপোর্ট বা রেসিস্ট্যান্স স্তরে প্রাইস ব্রেকআউট (দাম স্তর ভেঙে যাওয়া) বা রিভার্সাল (দাম বিপরীত দিকে যাওয়া) চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি বড় বডির বুলিশ ক্যান্ডেল সাপোর্ট ভেঙে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নির্দেশ করতে পারে।মার্কেট সেন্টিমেন্ট বিশ্লেষণ:
প্যাটার্নের আকার, বডি এবং শ্যাডো বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় বাজারে ক্রেতা বা বিক্রেতার শক্তি বেশি। এটি সাপোর্ট এবং রেসিস্ট্যান্স স্তরে দাম কিভাবে আচরণ করবে তা নির্ধারণে সাহায্য করে।
৩. ট্রেডিং স্ট্রাটেজি:
ক্যান্ডেলস্টিক প্যাটার্ন ব্যবহার করে বুদ্ধিদীপ্ত ট্রেডিং স্ট্রাটেজি তৈরি করা যায়।
৪. বাজারের মনোভাব বিশ্লেষণ:
বিভিন্ন প্যাটার্ন ক্রেতা-বিক্রেতার মনোভাব এবং তাদের শক্তির ভারসাম্য সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
ক্যান্ডেলস্টিক হল বিনিয়োগ এবং ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য হাতিয়ার। এটি শুধু বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষণে সহায়তা করে না, বরং বিনিয়োগকারীদের কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সাহায্য করে। তবে, এটি সম্পূর্ণভাবে অন্য প্রযুক্তিগত এবং মৌলিক বিশ্লেষণের সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করাই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল চাবিকাঠি।
এটি ব্যবহারে ধারাবাহিক চর্চা এবং অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাজার সব সময় সরল গতিতে চলে না। সঠিক প্যাটার্ন এবং ট্রেন্ড চিহ্নিত করার দক্ষতাই সফল ট্রেডিংয়ের মূল।
Video material: